Follow us

নেত্রকোণা জেলার রোয়াইলবাড়ি দূর্গ

 

রোয়াইলবাড়ি দূর্গ: বাংলার প্রাচীন শাসনকর্তাদের ইতিহাস-ঐতিহ্যমন্ডিত এক ঐতিহাসিক স্থান। একসময় কত ঘটনাই না ঘটেছে এ দূর্গে। বাংলার সুলতান হুসেন শাহ, নছরত শাহ এবং ঈশা খাঁ’র অশ্বারোহী বাহিনীর ঠক ঠক শব্দে কিভাবেই না কেঁপেছে এই রোয়াইলবাড়ির মাটি; সে ইতিহাস আজ পুরোপুরি জানা না গেলেও তাঁদের অহংকার ও শৌর্য-বীর্যের সাক্ষী হয়ে আজো ঠাঁয় দাড়িয়ে আছে প্রাচীন দূর্গটি।

জানা গেছে ‘রোয়াইল’ একটি আরবী শব্দ। এর বাংলা অর্থ ‘ক্ষুদ্র অশ্বারোহী বাহিনী’। সুতরাং ‘রোয়াইলবাড়ি’ এর অর্থ দাঁড়ায় ‘অশ্বারোহী বাহিনীর বাড়ি’। কালক্রমে রোয়াইলবাড়ি এখন একটি পুরো গ্রাম এবং সমগ্র ইউনিয়নের নাম। নেত্রকোণার কেন্দুয়া উপজেলা সদর থেকে সাত কিলোমিটার দূরে গ্রামটির অবস্থান। রোয়াইলবাড়ি দূর্গের পশ্চিম পাশ দিয়ে বয়ে চলেছে বেতাই নদী। ঈশা খাঁর স্মৃতি বিজড়িত আরেক ঐতিহাসিক স্থান কিশোরগঞ্জের করিমগঞ্জ উজেলার জঙ্গলবাড়ি দূর্গও রোয়াইলবাড়ি থেকে খুব বেশী দূরে নয়।

ঐতিহাসিকদের মতে, সুলতান আলাউদ্দিন হুসেন শাহ্ ১৪৯৮ খ্রিষ্টাব্দে কামরূপের রাজা নিলাম্বরের বিরুদ্ধে এক প্রচন্ড যুদ্ধ পরিচালনা করে কামরূপ রাজ্য দখল করেন। এরপর কিছুদিন তাঁর পুত্র নছরত শাহ্ কামরূপে শাসন করেন। কিন্তু কিছুদিন যেতে না যেতেই প্রতিপক্ষের আক্রমণের মুখে তিনি বিতাড়িত হন এবং এক পর্যায়ে কামরূপ থেকে পালিয়ে আসতে হয়। কথিত আছে, নছরত শাহ্ কামরূপ থেকে পালিয়ে পূর্ব ময়মনসিংহের (বর্তমান নেত্রকোণার) রোয়াইলবাড়িতে এসে আশ্রয় গ্রহণ করেন। তিনি এর নামকরণ করেন ‘নছরত ও জিয়াল’ (কোন কোন ঐতিহাসিকের মতে- ‘নছরত আজিয়াল’)। পরবর্তীতে তাঁর শাসন অন্তর্গত সমগ্র প্রদেশটিই (বৃহত্তর ময়মনসিংহ) ‘নছরতশাহী পরগণা’ নামে পরিচিত হয় এবং আকবর শাহ্‌র সময় পর্যন্তও পরগণাটি এ নামেই পরিচিত ছিল। এরপর বাঙ্গালীর গৌরব, মসনদে আলী ঈশা খাঁ এ অঞ্চলে বিশাল সম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করে কিশোরগঞ্জের জঙ্গলবাড়ি ও নেত্রকোণার রোয়াইলবাড়ি দূর্গের নিয়ন্ত্রণ নিজ হাতে নেন। জানা গেছে রোয়াইলবাড়ি থেকে জঙ্গলবাড়ি পর্যন্ত যাতায়াতের একটি রাস্তাও ছিল, যা ধ্বংস হতে হতে কিছুদিন আগে পুরোপুরি নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়। এদিকে ঈশা খাঁর মৃত্যুর পর তাঁর পারিষদ দেওয়ান জালাল এখানকার আধিপত্য গ্রহণ করেন। তিনি রোয়াইলবাড়ি দূর্গের ব্যাপক সংস্কার এবং দূর্গের বহিরাঙ্গনে একটি সুরম্য মসজিদ নির্মাণ করেন। এটি‘মসজিদ- এ জালাল’ বা ‘জালাল মসজিদ’ নামে পরিচিত ছিল।

এসব কিংবদন্তী ও ইতিহাস-ঐতিহ্যের সাক্ষী রোয়াইলবাড়ি দূর্গের বিস্তীর্ণ অংশ দু’যুগ আগেও মাটির নীচে চাপা পড়া অবস্থায় ছিল। প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ ১৯৯১ থেকে ১৯৯৩ সাল পর্যন্ত বিভিন্ন সময়ে রোয়াইলবাড়ি দূর্গে খনন কাজ পরিচালনা করে। দীর্ঘ সময়ের এ খনন কাজে মাটির নীচ থেকে বেরিয়ে আসে প্রাচীন প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনসমূহ। উদ্ধার করা হয়- ইটের দেয়ালবেষ্টিত দূর্গ, মূল প্রবেশদ্বার (সিংহদ্বার), বহুকক্ষবিশিষ্ট একাধিক ইমারতের চিহ্ন, সানবাঁধানো ঘাটসহ দুটি বড় পুকুর, দুটি পরিখা, বুরুজ ঢিবি বা উঁচু ইমারত (টাওয়ার), বারদুয়ারী ঢিবি, কবরস্থান, মসজিদ, মিহরাব, চওড়া প্রাচীর, লতাপাতা ও ফুলে-ফলে আঁকা রঙিন প্রলেপযুক্ত কারুকাজ, পোড়ামাটির অলংকৃত ইট, টালি, জ্যামিতিক মোটিফ, টেরাকোটা, বর্শা, প্রস্তরখন্ড এবং লোহা ও চিনামাটির তৈরি নানা ধরনের জিনিসপত্র।

প্রায় ৪৬ একর ভূমির উপর রোয়াইলবাড়ির প্রাচীন সুরক্ষিত এলাকাটি অবস্থিত। এর মোট আয়তন প্রায় ৫৩৩ X ৪২৬ মিটার। সমস্ত দূর্গ এলাকাটি তিনটি ভাগে বিভক্ত। মূল দূর্গের পূর্বদিকের ইটের দেয়ালে রয়েছে সিংহদ্বার (লায়ন গেইট)। পুকুরদুটি রয়েছে দূর্গের সামনের অংশের পূর্বদিকে। সিংহদরজা বরাবর একটি উঁচু রাস্তা দ্বারা পুকুর দুটি বিচ্ছিন্ন করা ছিল। দক্ষিণ দিকের মাটির দেয়ালের দু’পাশে ছিল দুটি পরিখা। আভ্যন্তরীণ পরিখাটি একটি নালার মাধ্যমে পুকুর দু’টির সঙ্গে সংযুক্ত ছিল। দক্ষিণ দিকের পরিখাটি বেতাই নদী থেকে আসা নৌযানসমূহ নোঙ্গর করার জন্য ব্যবহৃত হতো বলে অনুমান করা হয়। ধারণা করা হয়, দূর্গের উত্তর ও দক্ষিণ দেয়ালে বড় বড় পাথর খন্ড দিয়ে নির্মিত আরও দুটি প্রবেশ পথ ছিল। দূর্গের আভ্যন্তরীণ সুরক্ষিত এলাকার উত্তরাংশে রয়েছে একটি বুরুজ ঢিবি (উঁচু ইমারত বা টাওয়ার), একটি প্রবেশপথ ও কবরস্থান। বুরুজ ঢিবিটির পরিমাপ প্রায় ২৫ মিটার X ২১ মিটার X ৭ মিটার। এছাড়াও বুরুজ ঢিবির পাশ থেকে উদ্ধার করা হয়েছে পাঁচ কক্ষ বিশিষ্ট একটি ভবনের ধ্বংসাবশেষ, সমান্তরাল তিনটি দেয়াল, প্রবেশদ্বার, ওয়াচ টাওয়ার (পর্যবেক্ষণ চিলেকোঠা) ও চওড়া সিঁড়ি। খননের সময় পর্যন্ত দূর্গের অভ্যন্তরের উত্তর ও পূর্ব দিকের প্রবেশ দেয়াল দুটি সাদা, নীল, সবুজ ও বাদামী রংয়ের চকচকে টালি দিয়ে বিভিন্ন ফুল-ফল, লতাপাতা এবং দড়ির নকশায় সজ্জিত ছিল। এখন এগুলো শেওলা ও ঝোপ ঝাড়ে ঢেকে গেছে। বারোদুয়ারী ঢিবিটির অবস্থান সিংহ দরজার দক্ষিণ প্রান্তে। এলাকায় এটি ‘বারো দরজার ইমারত’ নামে পরিচিত। খননের পর এখানে কারুকার্যমন্ডিত যে মসজিদের ধ্বংসাবশেষ পাওয়া যায়; ধারণা করা হয়- এটিই দেওয়ান জালাল নির্মিত ‘মসজিদ-এ জালাল’ বা ‘জালাল মসজিদ’। জানা যায়, এ মসজিদের ১৫টি গম্বুজ ছিল। এছাড়া মসজিদের কাঠামোতে ছিল ১২টি দরজা, ৫টি খুতবা পাঠের মেহরাব (মিম্বর) এবং মার্বেল পাথরের তৈরি বিশাল কয়েকটি খিলান। মসজিদের দেয়ালগুলো প্রায় সাত মিটার চওড়া। এতে ঝিনুকচুন ও সুড়কির প্রলেপযুক্ত ইট ব্যবহার করা হয়। চমৎকার সূর্যমূখী ফুলের নকশায় পরিপূর্ণ ছিল এটির দেয়ালগুলো। দূর্গের দক্ষিণ দিকের খোলা ময়দানটিকে সৈন্যবাহিনীল প্যারেড গ্রাউন্ড হিসাবে চিহ্নিত করা হয়। এছাড়াও দূর্গের বিভিন্ন অংশে বেশ কয়েকটি ভবন বা ইমারতের ধ্বংসাবশেষ পাওয়া যায়। কথিত আছে- এ দুর্গের একটি কবরে শুয়ে আছেন নেয়ামত বিবি। প্রত্নতত্ত্ব গবেষকদের মতে, রোয়াইলবাড়ি দুর্গের সমস্ত স্থাপনা সুলতানী আমলের স্থাপত্য রীতিতে নির্মিত হলেও এর কারুকাজ ছিল অনেক বেশী নান্দনিক ও শিল্পসমৃদ্ধ।

দুর্গর ধ্বংসাবশেষের পাশের একটি স্থানে এলাকাবাসীর উদ্যোগে একটি মাদ্রাসা স্থাপন করা হয়েছে। দুর্গ এলাকার বেতাই নদীর পাড়ে গড়ে উঠেছে রোয়াইলবাড়ি বাজার। ঐতিহাসিক স্থানটির প্রাচীন নিদর্শনগুলোর সাথে পরিচিত হতে প্রায় প্রতিদিনই কিছু না কিছু লোক আসেন এখানে। এএলাকাটি দেশের একটি আকর্ষণীয় পর্যটন স্পটে পরিণত হতে পারে।

ময়মনসিংহ, কিশোরগঞ্জ ও নেত্রকোণা থেকে বাস বা যে কোন ধরণের ছোটোখাটো যানবাহন নিয়ে পৌঁছা যায় রোয়াইলবাড়িতে। সেখানে গেলে অশ্বারোহী বাহিনীর সেই ঠক ঠক শব্দ আর কোনোদিনই শোনা যাবেনা যদিও, কিন্তু আপনার অন্তর্দৃষ্টি ঠিকই কিছুক্ষণের জন্য আপনাকে সুলতান- ঈশা খাঁ আমলের সেই হারানো দিনগুলোতে নিয়ে যাবে। এর সুদৃশ্য ইমারত, অপরূপ কারুকার্যখচিত পুরাকীর্তির ধ্বংসাবশেষ হাতছানি দিয়ে ডাকবে আপনাকে- আমাদের সবাইকে।

কিভাবে যাওয়া যায়:

ময়মনসিংহ, কিশোরগঞ্জ ও নেত্রকোণা থেকে বাস বা যে কোন ধরণের ছোটোখাটো যানবাহন নিয়ে পৌঁছা যায় রোয়াইলবাড়িতে। ঢাকা থেকে বাসযোগে নেত্রকোণা, নেত্রকোণা থেকে কেন্দুয়া। কেন্দুয়া পৌরসভা থেকে বাস/রিকসা/সিএনজি যোগে সাহিতপুর বাজার যেতে হবে। সেখান থেকে অটো/ইঞ্জিনচালিত যন্ত্র দিয়ে সরাসরি রোয়াইলবাড়ী বাজারে যাওয়া যায়। বাজার থেকে পায়ে হেটে বা রিক্সায় যাওয়া যায়।


LATEST POSTS
যাচাই ডট কম-একশপের কার্যক্রম শুরু

Posted on মার্চ ১৫th, ২০২৩

রিয়েলমি ফ্যান ফেস্ট ২০২২-এর বিজয়ীর নাম প্রকাশ

Posted on মার্চ ১৫th, ২০২৩

৪০০ শতাংশ বেশি বিক্রির রেকর্ড অপো রেনো এইট টি’র

Posted on মার্চ ১২th, ২০২৩

বেঙ্গল গ্রুপের নারী দিবস উদযাপন

Posted on মার্চ ৯th, ২০২৩

ওয়েস্টার্ন পোশাক নিয়ে ‘ঢেউ’-এর যাত্রা শুরু

Posted on মার্চ ৯th, ২০২৩

ওয়ালটন ফ্রিজ কিনে ১০১টি বাড়িভর্তি পণ্য ফ্রি পেলেন রামুর জসিম উদ্দিন

Posted on মার্চ ৯th, ২০২৩

৭০ মিলিয়ন ব্যবহারকারীর প্রথম পছন্দ অপো রেনো সিরিজ

Posted on ফেব্রুয়ারি ২৭th, ২০২৩

বাংলাদেশেই বিশ্বমানের সফটওয়্যার উৎপাদন করছে ইউনিসফট

Posted on ফেব্রুয়ারি ২৭th, ২০২৩

১ মার্চ থেকে বরিশাল রুটে শুরু হচ্ছে নভোএয়ারের ফ্লাইট

Posted on ফেব্রুয়ারি ২৬th, ২০২৩

আন্তর্জাতিক শিক্ষায় শিক্ষার্থীদের পাশে স্টাডি গ্রুপ

Posted on ফেব্রুয়ারি ২৪th, ২০২৩